যা যা আছে

অপবিজ্ঞান

অনির্বাণ কুণ্ডু

পার্থ ঘোষ


অনুবাদ: সুনন্দ পাত্র

মূল ছবি: Mikhail Nilov

অপবিজ্ঞান হল এমন এক ধরনের বিশ্বাস, দাবি অথবা অনুশীলন—যাকে বিজ্ঞানের খোলসে উপস্থিত করা হয়, কিন্তু, যা বিজ্ঞানের প্রয়োজনীয় নীতি, পদ্ধতি বা যুক্তি মেনে চলে না। বারংবার প্রমাণ-সংগ্রহ করা এবং মিথ্যা-প্রতিপাদনযোগ্য অনুমানগুলিকে অনুক্ষণ যাচাই করার ওপরই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সার্থকতা নির্ভর করে। অপবিজ্ঞানগুলি এই মানদণ্ড অনুসরণ করে না। অপবিজ্ঞানকে অনেকসময় ছদ্মবিজ্ঞান, বিকল্প-বিজ্ঞান বা প্রান্তিক বিজ্ঞানও বলা হয়। বিজ্ঞানের ভিত্তি (এবং অগ্রগতির রহস্য) হল সতর্ক, নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষানিরীক্ষা এবং তাদের ফলাফলের সুচিন্তিত, সুচারু বিশ্লেষণ। অপবিজ্ঞানে ঠিক এই জিনিসগুলোরই অভাব। অপবিজ্ঞানের কিছু উদাহরণ: ফ্রেনোলজি (কোনো ব্যক্তির করোটির উচ্চাবচতার মাপজোক করে তার মানসিক অবস্থা ও চরিত্রের নির্ণয়), জ্যোতিষচর্চা, অতীন্দ্রিয় অনুভব (extrasensory perception—ESP), রিফ্লেক্সোলজি (হাত ও পায়ের পাতা এবং কানের বিভিন্ন অংশে চাপ প্রয়োগ করে করা চিকিৎসা), জন্মান্তর তত্ত্ব এবং সায়েন্টোলজি

বিজ্ঞান আর অপবিজ্ঞানের পার্থক্য তবে ঠিক কী? বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির কঠোর নিয়মাবলির প্রাচীর যারা ডিঙোতে পারে না, অথচ নিজেদের বিজ্ঞান বলে দাবি করে—খুব নিরীহ হলেও, তারা অপবিজ্ঞান। আর বিধি বাম হলে? নিখাদ জালিয়াতি। বিজ্ঞানের একটিমাত্র সূত্রই যদি মনে রাখতে হয়, তবে তা হল: কিছুই—কোনোকিছুই—প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয় এবং যতক্ষণ না পর্যন্ত অকাট্য প্রমাণ উপস্থিত করা হচ্ছে, কোনোকিছুতেই পূর্ণ বিশ্বাস করা বারণ। এখানে ‘প্রমাণ’ মানে কিন্তু জনশ্রুতি/কিংবদন্তী নয়, বা এমন কোনো ‘পবিত্র’ বাণী নয়—যাকে পরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই করে দেখা যাবে না। ঠিক এই কারণেই, বহু বইয়ে বারংবার লেখা থাকা সত্ত্বেও, “ভূত সত্যিই আছে” একটি বিজ্ঞানসম্মত বক্তব্য নয়। যদি কখনো সন্দেহ হয়, যে কোনোকিছু ‘বিজ্ঞান’ কিনা, তবে এই বিপদচিহ্নগুলির জন্যে চোখ খোলা রাখতে পারো:

  • বর্তমানে উপলভ্য বিজ্ঞানের জ্ঞানভাণ্ডার ও নীতির পরিপন্থী—এমন কিছু বক্তব্য বা ধারণার ওপর বিষয়টি নির্ভর করে।
  • জনপ্রিয় কিছু আচার ও কুসংস্কারের ওপর বিষয়টি নির্ভর করে এবং তাদের ঠিক প্রমাণ করার খুব চেষ্টা করে।
  • বিষয়টি, বহুলাংশেই, কোনো বিস্মৃত জ্ঞানভাণ্ডার—প্রাচীন, কল্পিত কোনো “গভীর জ্ঞান”, যা অতীতে নাকি ছিল, এখন আমরা ভুলে গেছি—এর ওপর নির্ভর করে।
  • সপক্ষে প্রমাণের জন্য, পরীক্ষানিরীক্ষার বদলে, পুঁথি ও শাস্ত্রে লেখা বক্তব্যের ওপরেই বেশি নির্ভর করে।
  • অপবিজ্ঞানে উৎসাহের কারণ—যত না প্রকৃতিকে জানার কৌতূহল, তার চেয়ে অনেক বেশি – খেলো দেশপ্রেম আর কে কত বড় হনু—তা প্রমাণের চেষ্টা।

উপরের এই বিপদচিহ্নগুলিকে কিছু উদাহরণ-সহযোগে বোঝার চেষ্টা করা যাক:

  1. বিজ্ঞানের অর্জিত জ্ঞানভাণ্ডারের বিরুদ্ধাচরণ: যেসব তত্ত্বে কিছু জানা বা অজানা বস্তুর ঘাড়ে রহস্যময় একগুচ্ছ বৈশিষ্ট্য চাপানো হয়, তাদের সম্পর্কে সর্বদা সন্দিহান থাকা ভালো। জ্যোতিষ যেমন একটা ভালো উদাহরণ। জ্যোতিষচর্চায় গ্রহ-নক্ষত্রের ওপর কিছু রহস্যময় বৈশিষ্ট্য চাপানো হয়—যা থেকে প্রমাণ করার চেষ্টা করা যায়, যে, তারা আমাদের জীবনকে প্রভাবিত করতে পারে। নিউটনের সূত্রের কিছু সাধারণ প্রয়োগের ফলে খুব সহজে দেখানো যায়—যদি আমাদের ওপর তাদের অভিকর্ষের কোনো প্রভাব থেকেও থাকে—তা অতি ক্ষুদ্র, অকিঞ্চিৎকর। যে দুটি মহাজাগতিক বস্তুর প্রভাব পৃথিবীর গতির ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে, তারা হল সূর্য ও চাঁদ। কিন্তু তাদের সেই প্রভাব, সামান্য এক-দুটি প্রস্তরখণ্ড/রত্ন ধারণ করে কাটানো যাবে—এই দাবিটি আরো বেশি উদ্ভট। তা-ই যদি সত্য হত, তবে তোমার বাড়ির বইয়ের আলমারি বা তোমার গাড়ির প্রভাব তোমার ওপর থেকে কাটানোর জন্যে আরও বড় কোনো রত্ন ধারণ করতে হত। কয়েক বছর আগে আমাদের দেশে এমনই উদ্ভট একটি দাবি উঠেছিল—প্রাচীন ভারতে নাকি এমন উড়ুক্কু যন্ত্র (যেমন পুষ্পক রথ) আবিষ্কার হয়েছিল, যা শুধু বাতাসে ভেসে থাকতে পারতো—তা-ই নয়, এমনকি বাতাসে পিছুও হটতে পারতো। বায়ুগতিবিদ্যা (Aerodynamics) নিয়ে সামান্য কাজ চালানোর মতো ধারণাও যাদের আছে, তারাও জানে—এরোপ্লেনের মতো যেসব উড়ুক্কু যন্ত্র শুধু সামনে এগোনোর মাধ্যমেই বাতাসে উড়তে পারে (আমরা বেলুন বা ড্রোনের কথা বলছি না), তাদের পক্ষে এমনটা করা অসম্ভব—ভৌতবিজ্ঞানের সূত্রকে তবে অমান্য করা হয়।

  2. বিশ্বাস ও কুসংস্কার নির্ভরতা: আমরা প্রায় সকলেই কখনো না কখনো শুনেছি, যে গ্রহণের সময় কিছু খাওয়া বা পান করা উচিত নয়। সম্পূর্ণ কুসংস্কার এইটি। লোকে যদিও এর পিছনেও ‘বিজ্ঞানসম্মত’ যুক্তি উদ্ভাবনের চেষ্টা করে; তাদের বক্তব্য—গ্রহণের সময় খাবারের মধ্যে ক্ষতিকারক জীবাণুর সংখ্যা বেড়ে যায়, কারণ তাদের মারার জন্যে কোনো সূর্যালোক তখন থাকে না। বাজে কথা। এমন হলে, রাতের বেলা যখনই কেউ কিছু খেতো, অসুস্থ হয়ে পড়তো। কয়েক মিনিটের জন্যে সূর্যালোক না থাকা কারুর পক্ষেই ক্ষতিকারক নয়।

  3. বিস্মৃত জ্ঞানভাণ্ডার: অপবিজ্ঞানের সপক্ষে অনেক সময়েই এমনধারা যুক্তি সাজানো হয়—“অমুক প্রাচীন পুঁথিতে তমুক কথাটি লেখা আছে, অতএব, নিশ্চয়ই পুরাকালের মানুষ এসব জানতেন, আমরাই সে সব ভুলে গেছি”। অবশ্যই আমরা এমন অনেক প্রযুক্তি ভুলে গিয়েছি, যা প্রাচীনকালে ছিল, যেমন, মিশরের মমি-তৈরির পিছনের প্রযুক্তি। কিন্তু সেটা যে আমরা শুধুমাত্র কোনো প্রাচীন প্যাপিরাসে এই পদ্ধতির অস্তিত্বের উল্লেখ থেকে জেনেছি—তা নয়, আমরা অনেক মমি ‘আবিষ্কার’ও করেছি, আর তাই, “মমি সত্যিই বানানো হত”—এই বক্তব্যের সপক্ষে প্রমাণ আমাদের হাতে আছে। এমন অনেক প্রযুক্তিও ছিল, যা আমরা পুনরাবিষ্কার করেছি। রোমানরা তাদের বিশাল ও আশ্চর্যজনক টেকসই ইমারতগুলি—যার বেশকিছু আজও দাঁড়িয়ে আছে—বানাতো এমন কংক্রিট দিয়ে, যাতে আগ্নেয় ছাই (Pozzolanic ash) মেশানো থাকতো। এই কংক্রিটের গঠনরহস্য এই সবে কিছুদিন আগে বোঝা গেছে। কিন্তু, “২০০০ বছর আগে আমাদের হাতে বেতার-প্রযুক্তি ছিল” বা “আমাদের হাতে সর্বরোগহর মহৌষধ ছিল”—এমন সব বক্তব্য, আর যাই হোক, বিজ্ঞান নয়। কেন নয়—তা তুমি জানো। কারণ—কিছু প্রাচীন পুঁথিতে পাওয়া কিছু গল্পকথা বা কিছু আধুনিক লেখকের উর্বর কল্পনার ফসল ছাড়া—কোনোভাবেই এদের সপক্ষে তুমি কোনো প্রমাণ প্রদর্শন করতে পারবে না। আজ যা ঘটা অসম্ভব, অতীতেও তা ঘটা অসম্ভবই ছিল। যেমন, আমরা নিশ্চিতভাবে জানি, প্রাচীন ভারতের শল্যচিকিৎসকরা একটি জখম নাককে কৃত্রিক নাক দিয়ে বদলে দিতে পারতেন, কিন্তু কারুর মাথাকে একটি হাতির মাথা দিয়ে প্রতিস্থাপন করা? এমন বানানো কথায় আক্ষরিক বিশ্বাস করা, বা সেইসব শল্যচিকিৎসককে নিয়ে গর্ব করা—কেবল মূর্খদেরই শোভাবর্ধন করে। আবার ধরো, হাতেকলমে পরীক্ষা আর আরোহী যুক্তির ওপর নির্ভর করে প্রাচীন ভারতবাসীরা অঙ্ক, জ্যোতির্বিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাবিদ্যা ও শল্যচিকিৎসার ওপর বেশকিছু খুবই গুরুত্বপূর্ণ পাঠ্য প্রস্তুত করেছিলেন। সেই রচনাগুলি অনেকাংশেই দুর্বোধ্য বা সাংকেতিক এবং অনেকসময়েই সেগুলি যুক্তি-শৃঙ্খলের সবক-টি ধাপ লিপিবদ্ধ করে না, কিন্তু তাদের অন্তিম সিদ্ধান্তগুলি দেখে সেই যুক্তি-শৃঙ্খলের অস্তিত্ব বোঝা যায়। এমন একটি উদাহরণ হল—আর্যভট্টীয়। পুঁথিটি সাংকেতিক শ্লোকে লেখা, আর তাই তার অর্থোদ্ধার করতে আমরা পরবর্তীকালের গণিতজ্ঞদের দেওয়া ব্যাখ্যার ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হয়েছি। আধুনিক বিজ্ঞান মূলত পাশ্চাত্যের উদ্ভাবন—প্রমাণ বা সিদ্ধান্তের পথে নেওয়া অন্তর্বর্তী পদক্ষেপগুলিকেও সমান গুরুত্ব দেওয়ার গ্রিক ঐতিহ্য বহন করে। এইসব কারণে, প্রাচীন রচনা পাঠের সময়, আমাদের খুব সতর্ক থাকা উচিত—কোনটি বিজ্ঞান আর কোনটি কপোলকল্পনা।

  4. ঐশ্বরিক সত্য: কখনো কখনো তুমি এমনও শুনতে পাবে: “অমুক পবিত্র রচনায় তমুক কথাটা লেখা রয়েছে আর যেহেতু অমুক রচনা কখনোই ভুল হতে পারে না, তাই তমুক বক্তব্য ঠিক হতে বাধ্য”। বুঝতেই পারছো, এটা বিজ্ঞান নয়। আজ অবধি কোনো রচনাই কোনো সর্বজ্ঞ অস্তিত্বের হাতে বা নির্দেশে লেখা হয়নি, নইলে এত কাঁড়িকাঁড়ি ভুল কথা প্রাচীন রচনাগুলিতে লেখা থাকতো না। কথাগুলিকে সত্যিই সেইকালে হয়তো সত্য মনে করা হত, কিন্তু এতদিনে তারা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। বাইবেল-এর জেনেসিস অংশটি এর একটা ভালো উদাহরণ: আর্চবিশপ জেমস আশার (James Ussher) ওল্ড টেস্টামেন্ট থেকে সরাসরি বক্তব্য বেছে তুলে, মহাবিশ্বের সৃষ্টির সময়কাল নির্ধারণ করেন: ৪০০৪ খৃষ্টপূর্বাব্দ। যেকোনো প্রাচীন রচনা থেকেই এমন নানা উদাহরণ তুলে আনা যায়। কোনো পবিত্র গ্রন্থ কী বললো, না বললো—তার ওপর বিজ্ঞান নির্ভর করে না।

  5. উগ্র দেশপ্রেম: উগ্র দেশপ্রেমের ফলে বিভিন্ন দেশের মধ্যে যে পরস্পরকে টেক্কা দেওয়ার লড়াই শুরু হয়, বিজ্ঞানের পক্ষে তা সবচেয়ে ক্ষতিকর। বিজ্ঞান গোটা মানবজাতির সম্পদ। ছোট-বড় সমস্ত সভ্যতা বিজ্ঞানে কিছু না কিছু অবদান রেখেছে। আমরা তো দেখেইছি—বিজ্ঞানের পদ্ধতি, নিয়মাবলি কী কী—কীভাবে বিজ্ঞানের গবেষণা করা উচিত। বিজ্ঞানের এইসব নিয়ম মানে না—এমন বিষয় বা বস্তুকে, কেবল বিশেষ কোনো একটি সভ্যতায় নির্মিত হয়েছে বলেই, ‘বিজ্ঞান’ আখ্যা দেওয়া—বিজ্ঞানের সামগ্রিক ধারণার পরিপন্থী।

অপবিজ্ঞানের বৈশিষ্ট্য:

কোনো বিষয়, বিজ্ঞান না অপবিজ্ঞান—তা সবসময় স্পষ্ট নয়। সুবিধে হল, অপবিজ্ঞানের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়। এগুলি হল:

  • ধোঁয়াটে, অতিরঞ্জিত বা যাচাই-অযোগ্য দাবিদাওয়া: অপবিজ্ঞানের বহু দাবি যাচাই-ই করা যায় না। ফলত, তাদের সত্যতা না থাকলেও, তাদের মিথ্যা-প্রতিপন্ন করা যায় না।

  • খণ্ডনের বদলে সমর্থনের ওপর অতি-নির্ভরশীলতা: কোনো ঘটনা, একটি অপবিজ্ঞানের কোনো একটি দাবিকে সমর্থন করছে—এমন মনে হলেই, সেটিকে সেই দাবির প্রমাণ হিসেবে ধরা হয়। মিথ্যা প্রতিপন্ন না করা অবধি কোনো দাবিকে সত্য বলে ধরে নেওয়া হয়, আর এই অপ্রমাণ করা দায় চাপানো হয় তাদের ওপর—যারা এই দাবির সত্যতায় সন্দিহান।

  • বিশেষজ্ঞদের পরীক্ষার সম্মুখীন হতে সঙ্কোচ: অপবিজ্ঞানের অনুশীলনকারীরা, তাদের ধারণাগুলির প্রকাশ্য পরীক্ষা এড়িয়ে যায়। নিজেদের পরীক্ষালব্ধ তথ্য ভাগ করে নিতে তারা আপত্তি করতে পারে, এবং ব্যক্তিগত মালিকানা বা গোপনীয়তার অজুহাত দিয়ে নিজেদের এই আচরণের সমর্থন জোগাড় করার চেষ্টা করতে পারে।

  • জ্ঞানের অগ্রগতির ধারার অনুপস্থিতি: প্রকল্প বা অনুমানগুলিকে বারংবার যাচাই করার মাধ্যমে পরিমার্জন বা বর্জনের যে ধারা বিজ্ঞানের অঙ্গ, অপবিজ্ঞানগুলিতে তা নেহাতই অনুপস্থিত। কয়েক শতক—কখনো কয়েক হাজার বছর ধরে অপবিজ্ঞানের ধারণাগুলি একই থাকে। বস্তুত, যে ধারণা যত পুরোনো, অপবিজ্ঞানে তার বিশ্বাসযোগ্যতা ততই বেশি।

  • সমালোচনাকে ব্যক্তিগত আঘাত মনে করা: অপবিজ্ঞানের বিশ্বাসগুলির কোনো যৌক্তিক ভিত্তি থাকে না বললেই চলে, তাই তাদের প্রচারকরা এই বিশ্বাসগুলিকে শক্ত করে—সমালোচকদের শত্রু বানিয়ে। নিজের বিশ্বাসের পক্ষে যুক্তি না সাজিয়ে, তারা তাদের সমালোচকদের চরিত্র ও উদ্দেশ্যের সমালোচনায় ব্যস্ত থাকে।

  • বিভ্রান্তিকর ভাষার ব্যবহার: অপবিজ্ঞানীরা, বিজ্ঞানের আপাত-কঠিন পরিভাষা ব্যবহার করে নিজেদের ধারণাগুলিকে যুক্তিযুক্ত সাজানোর চেষ্টা করে। জল না বলে ডাইহাইড্রোজেন মনোক্সাইড বললে যেমন শোনায় আর কি!

নাছোড়বান্দা অপবিজ্ঞান:

বিজ্ঞানের মানদণ্ডে টিকে থাকার পরীক্ষায় ডাহা ফেল করা সত্ত্বেও অপবিজ্ঞানেরা টিকে থাকে। এমনকি, তারা ভয়ানক জনপ্রিয়ও হয়। উদাহরণ? জ্যোতিষশাস্ত্র।

জ্যোতিষ্কদের গতিপ্রকৃতি আর তূলনামূলক অবস্থানের হিসেব কষে, তার থেকে মানবসমাজ আর এই মাটির পৃথিবীর নানা তথ্য জেনে ফেলার দাবি করে জ্যোতিষ। বহু প্রাচীন সংস্কৃতিতেই এমনটা করার চেষ্টা করা হয়েছিল, বিশদে এবং জটিল কায়দায়। পাশ্চাত্যের ইতিহাসের অধিকাংশ সময় জুড়েই জ্যোতিষচর্চাকে একটি সম্মানজনক বিদ্যাচর্চা মনে করা হত এবং পণ্ডিতদের মধ্যে এর খুবই চল ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, আর আধুনিক বিজ্ঞানের উদ্ভবের ফলে, জ্যোতিষচর্চাকে প্রশ্নের মুখে পড়তে হল। সমস্যা দেখা দিল—একইসঙ্গে তাত্ত্বিক স্তরে ও পরীক্ষালব্ধ ফলাফলের ভিত্তিতে। অবশেষে, একসময় দেখা গেল, জ্যোতিষচর্চার না আছে কোনো বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা, না কোনো নির্ভরযোগ্য ব্যাখ্যা দেওয়ার ক্ষমতা।

বর্তমানে জ্যোতিষশাস্ত্রকে অপবিজ্ঞান হিসেবে মেনে নেওয়া হয়েছে। তা সত্ত্বেও, এর ভক্তের সংখ্যা অগণ্য। নিজেদের রাশিচিহ্নের খবর অনেকেই রাখেন, আর তার মধ্যে অনেকে সেই “চিহ্ন”-এর সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিগত স্বভাবচরিত্রের খবরও রাখেন। ইন্টারনেটে আর ছাপা কাগজে রাশিচক্র আর তাদের বাণী নিয়ে অঢেল শব্দ খরচ করা হয়, লোকে পড়েও—সে যত অনিয়মিতই হোক না কেন। কেউ কেউ আবার মনে করে—জ্যোতিষ বিজ্ঞানসম্মত। এ নিয়ে হওয়া গবেষণা ইঙ্গিত দেয়—সাধারণ জনমানসে বিজ্ঞানের নীতি ও পদ্ধতি নিয়ে পরিচ্ছন্ন ধারণার অভাব-ই অপবিজ্ঞানের এই নাছোড়বান্দা রমরমার রহস্য। উলটোদিকে, এমনও দেখা যায়—বিজ্ঞানসম্মত যুক্তি তাদের নিজেদের বদ্ধমূল ধারণার বিপক্ষে যাচ্ছে দেখলে অনেকে আর বিজ্ঞানের পদ্ধতির ওপর ভরসা রাখেন না—ফলত, তাঁরা নিজেদের (বা অন্যদেরও) কঠিন সঙ্কটে ফেলতে পারেন।

একটা ছোট্ট অঙ্ক:
বড় রাস্তায় মাঝেমাঝেই তোমাদের যেসব ১০ চাকার ট্রাক পেরিয়ে যায়, ধরো, সেইরকম একটি ট্রাক (ভর, ধরো — ২০ টন) তোমার থেকে ২ মিটার দূর দিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছে। এই ট্রাকটির জন্যে তোমার ওপর ক্রিয়াশীল অভিকর্ষ বলের পরিমাণ আর বৃহস্পতি গ্রহের জন্যে ক্রিয়াশীল অভিকর্ষ বলের পরিমাণের অনুপাত কত হবে? বুঝতেই পারছো, অভিকর্ষের সূত্রটি ব্যবহার করতে হবে:
\[ F = G \frac{M m}{r^2} \]
যা যা তোমার জানার দরকার: ১ টন = ১০০০ কিলোগ্রাম, বৃহস্পতি থেকে তোমার দূরত্ব \(\sim\) ৬১৫৪৯৪৩০৬৩০০ মিটার আর বৃহস্পতির ভর \(\sim\) ১.৮৯৮\(\times\) ১০\(^{২৭}\) কিলোগ্রাম।
(ইঙ্গিত: সব ঠিকঠাক করলে অনুপাত বেরোবে ১-এর কাছাকাছি। এখন ভাবার বিষয় হল: এই ট্রাকটির প্রভাব কাটাতে তুমি কোন রত্ন পরবে?)

বিপজ্জনক অপবিজ্ঞান:

জ্যোতিষে বিশ্বাস হয়তো কারুর পক্ষে সরাসরি ক্ষতিকর না-ও হতে পারে, কিন্তু অন্যান্য অপবিজ্ঞানে বিশ্বাস অনেকরকম ক্ষতি ডেকে আনতে পারে—বিশেষ করে, যেখানে সেই বিশ্বাসীর স্বাস্থ্য জড়িয়ে থাকে। বিজ্ঞানপ্রতিম, কিন্তু আদতে মোটেই বিজ্ঞানসম্মত নয়—এমন সব চিকিৎসাপদ্ধতি—অকেজো, খরচাবহুল, এমনকি বিপজ্জনকও হতে পারে—জড়িত রোগীর পক্ষে। বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিগুলিকে পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে নিরাপদ এবং কার্যকরী প্রমাণ করা হয়। অপবিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসাপদ্ধতির প্রয়োগের ফলে সেইসব চিকিৎসা পেতে রোগীর দেরি হতে পারে, এমনকি নিরাময়ের সম্ভাবনা লুপ্তও হয়ে যেতে পারে। সোজা কথায়, প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসাপদ্ধতির বদলে অপবিজ্ঞানের দ্বারস্থ হলে, ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।

বিজ্ঞানে ধাপ্পা / জালিয়াতি, হেত্বাভাস (Scientific Hoaxes / Frauds and Fallacies):

শুধু ছদ্মবিজ্ঞানই যে বিজ্ঞানের অপব্যবহার, তা নয়। ধাপ্পা, জালিয়াতি আর হেত্বাভাসও বিজ্ঞানসাধনাকে ভুল পথা চালিত করতে পারে, রোগীর জীবনকে বিপদের মুখে ফেলতে পারে, অথবা জনসমাজকে বিভ্রান্ত ও বিপথে চালিত করতে পারে। বিজ্ঞানের অপব্যবহারের এই দুই ধরনেরই একটি করে উদাহরণ এখানে দেওয়া হল:

ভ্যাক্সিন-অটিজ়ম ধাপ্পা: তুমি হয়তো শুনেছো—কিছু ভ্যাক্সিনের ব্যবহার কমবয়সী শিশুর পক্ষে শারিরীক বিপদের কারণ; কথাটা সত্য নয়। অনেকদিন ধরে টিকে থাকা এই ধারণাটি না বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে প্রমাণিত, না ওই বিষয়ের অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ এটা মানেন। ১৯৯৮ সালে বিলেতের একটি সম্মানিত চিকিৎসা-সম্পর্কিত পত্রিকা—‘ল্যান্সেট’-এ একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়, যার গবেষণার ফলাফলের পিছনে সুচারু একটি ধাপ্পা ছিল। অ্যান্ড্রু ওয়েকফিল্ড (Andrew Wakefield) ছিলেন এই রচনাটির মূল লেখক। এই নিবন্ধে ওয়েকফিল্ড ও তাঁর সহকর্মীরা মাত্র ১২জন শিশুর শারিরীক অবস্থা ও চিকিৎসার বিবরণ দেন; যাদের সকলকে MMR (হাম/মিজ়লস, মাম্পস, রুবেলা) ভ্যাক্সিন দেওয়া হয়েছিল এবং ভ্যাক্সিন দেওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই যাদের অধিকাংশের মধ্যে অটিজ়মের লক্ষণ প্রকাশ পায়।

এই গবেষণায় গুচ্ছের সমস্যা ছিল: পরীক্ষালব্ধ ফলাফলের বিকৃতি, নৈতিক অন্যায়, পরীক্ষা-নির্মাণে গঠগত ত্রুটি, ইত্যাদি। এই নিবন্ধটি এর পরে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে (বৈজ্ঞানিকদের সমাজে এ এক গভীর তাৎপর্যের ঘটনা!), অধিকাংশ সহ-লেখক ওই নিবন্ধ থেকে নিজেদের নাম সরিয়ে নিয়েছেন, ওয়েকফিল্ডের ডাক্তারি করার লাইসেন্স কেড়ে নেওয়া হয়েছে। পরে আরও খবর প্রকাশিত হয়েছে—একদল ব্যক্তি সেসময় ভ্যাক্সিন প্রস্তুতকারক সংস্থাদের বিপক্ষে মামলা লড়ছিলেন; ওয়েকফিল্ডের গবেষণার খরচ সেই দল বহন করছিল। এর পরে সহস্রাধিক এরকম গবেষণা হয়েছে, যারা MMR ভ্যাক্সিন আর অটিজ়মের মধ্যে কোনোরকম সম্পর্ক দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে।

দুঃখের বিষয় হল, তদ্দিনে যা ক্ষতি হওয়ার, হয়ে গেছে। সন্তানের অটিজ়মের সম্ভাবনায় অনেক বাবা-মা নিজেদের অপত্যকে ভ্যাক্সিন দেওয়া থেকে বিরত থেকেছেন। বিলেতের সমাজে MMR ভ্যাক্সিন দেওয়ার হার ছিল ১০০%, এই গোলমালের পরের কয়েক বছরে তা ৮০%-এ নেমে আসে। বর্তমানে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা একমত, যে ওয়েকফিল্ডের এই ধাপ্পার ফলে লক্ষ লক্ষ শিশুর স্বাস্থ্যহানির ঝুঁকি বিপজ্জনকভাবে বেড়েছে, আর অটিজ়মের আসল কারণসন্ধানের উদ্দেশ্যে সাধিত গবেষণার তহবিলে অর্থের জোগান ক্রমান্বয়ে কমেছে।

পারস্পরিক সম্পর্ক—কার্যকারণ হেত্বাভাস (Correlation-Causation Fallacy): বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ব্যবহৃত পরিসংখ্যানগত পরীক্ষায় অনেক সময়েই দুটি চলরাশি (variable)-র মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক (correlation) নির্ণয় করা হয়। ধরা যাক, দু-রকম তথ্য কোনো গবেষণায় ব্যবহৃত হয়েছে, এই দুইয়ের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক কষে বের করলে, তা নির্দেশ করে যে ওই দুই রকম তথ্যরাজি নিজেদের কতটা কাছাকাছি বা দূরের। ব্যবহৃত তথ্যের মধ্যের এই সম্পর্ক পরবর্তী গবেষণা শুরু করার জন্যে জরুরি। কিন্তু একটি গোলমেলে যুক্তির হেত্বাভাস হল—পারস্পরিক সম্পর্কমাত্রই কার্যকারণ সম্পর্ক নির্দেশ করে। এই কারণে, বিজ্ঞানে সর্বাধিক অপব্যবহৃত প্রমাণের উদাহরণ হল এই ‘সম্পর্কনির্ণয়’। আদতে, দুটি চলরাশি সম্পর্কিত মানেই যে তাদের মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্ক থাকতে হবে, তার কোনো মানে নেই।

এই নামজাদা ওয়েবসাইটে এরকম অনেক সম্পর্কের লিস্টি সাজানো আছে। সাইটে কিছু কাজ চলায় আপাতত একটা ক্যাশেতে রাখা ইমেজ দেওয়া হল।


No comments

মন খুলে মন্তব্য করুন। আমাদের সময়-সুযোগ মতো মডারেশন হয়, তাই মন্তব্য এই পাতায় ফুটে উঠতে কিছু সময় লাগতে পারে। নইলে নিশ্চিন্ত থাকুন, খুব খারাপ কিছু বা স্প্যাম না করলে, মন্তব্য ঠিক বেরোবে এই পাতায়।