পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য
অনির্বাণ কুণ্ডু
ও
পার্থ ঘোষ
অনুবাদ: সুনন্দ পাত্র
মূল ছবি: XKCD |
এই বিভাগের শিরোনামটি —পদার্থবিদ রিচার্ড ফাইনম্যানের বিখ্যাত বক্তৃতামালার এক অংশবিশেষ (The Character of Physical Law; পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে গোটা বইটারই একটা স্ক্যান করা পিডিএফ আছে)-এর নামের প্রায় আক্ষরিক অনুবাদ; এর কারণ—এই নির্দিষ্ট বিষয়ের এই বইয়ের থেকে ভালো ব্যাখ্যা পাওয়া দুষ্কর, আর বিজ্ঞানে উৎসাহী সমস্ত পড়ুয়ারই এই বইটা একবার অন্তত পড়া উচিত।
পদার্থবিদ্যার যেকোনো সূত্রের সার্থক হওয়ার প্রথম লক্ষণ হল: সূত্রটিকে সহজ হতে হবে (simplicity)। ‘সহজ’ হওয়ার মানে কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে সহজ—তা নয়! কোনো একটি সূত্রের সমস্ত অন্তর্নিহিত অর্থ, তাৎপর্য—অঙ্কের সাহায্য ছাড়া বোঝানো ভীষণ কঠিন—প্রায় অসম্ভবই বলা চলে। ফাইনম্যানের ভাষায়, অঙ্ক শুধু বিজ্ঞানের নয়, তার সমর্থনে নির্মিত যুক্তির ভাষাও বটে। তাই, এইখানে ‘সহজ’ বলার অর্থ—সূত্রটি, ঠিক যতটা প্রয়োজন, তার অতিরিক্ত পূর্বানুমান (initial assumptions) বা অবাধ পরামিতি (free parameter)-র সাহায্য নেয় না। সার্থক সূত্রের এই লক্ষণটির বর্ণনা প্রথম চতুর্দশ শতাব্দীতে করেন ইংরেজ দার্শনিক অকাম-এর উইলিয়াম (William of Ockham), আর তাঁর নামানুসারে (বিকল্প একটি বানান ধরে) এর নাম – Occam’s Razor (অকামের ক্ষুর)। পরমাণুর নিউক্লিয়াসের ভর কখনোই কোনো প্রাথমিক নিয়ম বা পূর্বশর্ত থেকে গণনা করা সম্ভব নয়। বিজ্ঞানীরা এই ভরের হিসেব করতে যে সূত্রটি ব্যবহার করেন, তাতে পাঁচটি অবাধ পরামিতি জড়িত—যাদের প্রত্যেকটি ব্যবহার করার পিছনে যথেষ্ট যুক্তি আছে—এবং দুনিয়ায় যত রকমের নিউক্লিয়াস (গুণতি হাজারের কোঠায়) আছে, তাদের সকলের ভর, এই সূত্রটি ব্যবহার করে, উচ্চমাত্রায় নিখুঁতভাবে (good precision) নির্ণয় করা যায়। এই সূত্রটি অকামের ক্ষুরের একটি সুন্দর উদাহরণ। আমরা চাইলেই পাঁচের বদলে দশটি পরামিতি ব্যবহার করতে পারতাম, যার ফলে আমাদের পরিসংখ্যানের ফলাফল আরও অল্প একটু নিখুঁত হতে পারতো, কিন্তু আরও পাঁচটা পরামিতি ব্যবহার করে পাওয়া ওই সামান্য পরিসংখ্যানগত উন্নতি—আমাদের পড়তায় পোষাতো না।
দ্বিতীয় যে বৈশিষ্ট্যটি নিয়ে আমাদের মাথা ঘামাতে হবে, তা হল: কোনো সূত্র-র উপযোগিতার দৌড় (range of applicability) কতটা? একটি সার্থক ভৌত-সূত্রের পূর্বাভাস-ক্ষমতা (predictability) বেশ বেশি হওয়া উচিত, অর্থাৎ, সূত্রটিকে অধুনা-লভ্য বেশ কিছু পর্যবেক্ষণের ফলাফলের ব্যাখ্যা দিতে হবে শুধু তা-ই নয়, এখনো অদেখা কোনো ফলাফলের ভবিষ্যদ্বাণীও করতে হবে। নিউটনের মাধ্যাকর্ষণের সূত্রের কথাই আবার ধরা যাক। এই সূত্রটিকে কাজে লাগিয়ে ইউরেনাস গ্রহের কক্ষপথের যে চেহারা পাওয়া যায়, পর্যবেক্ষণের ফলাফলের সঙ্গে তার সামান্য পার্থক্য দেখা যায়। এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে উরব্যাঁ ল’ ভেরিয়ে (Urbain Le Verrier) এবং জন অ্যাডামস (John Couch Adams) দু-জনে আলাদা-আলাদাভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করেন, যে, ইউরেনাস গ্রহের পিছনে (অর্থাৎ ইউরেনাসের যেদিকে আমরা, তার উলটোদিকে) আর একটি গ্রহ আছে—নেপচুন—যার আকর্ষণেই ইউরেনাসের অমন অন্যরকম চলন। তাঁরা অঙ্ক কষে আকাশের যে অংশে গ্রহটিকে দেখতে পাওয়ার কথা বলেছিলেন, প্রায় সেখানেই তাকে খুঁজে পান জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। আরেকটি উদাহরণ হল, ডেনমার্কের বিজ্ঞানী ওলে রোয়েমার (Ole Rømer) যখন প্রথম আলোর গতি মেপেছিলেন—বৃহস্পতির উপগ্রহদের গ্রহণ পর্যবেক্ষণ করে। এই মাপজোকের সময় তিনি শুধু নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ সূত্রটিকে ঠিক ধরে নিয়েছিলেন।
তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হল: সূত্রটির ব্যবহার বা প্রয়োগ কতটা সর্বজনীন (universality)? শুধু আমরা কেন, গুহাবাসী আদিম মানুষও জানতো, যে, পৃথিবী আপেলকে আকর্ষণ করে বলেই আপেল গাছ থেকে মাটিতে পড়ে। তাই, শুধু ওইটুকু বলতে পেরেই অভিকর্ষের আবিষ্কার হয়েছিল—এমন বলা যায় না। নিউটনের মাহাত্ম্য ছিল, তিনি আবিষ্কার করেছিলেন—পার্থিব আপেল থেকে শুরু করে, সৌরজগত, এমনকি সুদূর ছায়াপথ (galaxy)—এই সূত্রটি সর্বত্র উপযোগী। এই আবিষ্কারের জন্যেই আমরা নিউটনকে কৃতিত্ব দিই।
একটি সংক্ষিপ্ত উদাহরণ:
বিজ্ঞানের অগ্রগতি কীভাবে হওয়া উচিত—বোঝা যায় আলোর স্বরূপ-সন্ধানের ইতিহাস ঘাঁটলে। বিজ্ঞানে আরোহী যুক্তিপ্রয়োগের এক উৎকৃষ্ট নমুনা হল ১৭০৪ সালে প্রকাশিত নিউটনের অপটিক্স (Opticks)। আলোর চরিত্র বোঝার উদ্দেশ্যে নিউটন একের পর এক পরীক্ষা সম্পাদন করেছিলেন। তৎকালীন প্রচলিত গোঁড়া মতবাদ ছিল—সূর্য থেকে আসা সাদা আলো পবিত্র। এই আলো আর প্রিজমের ব্যবহার করে তিনি এই মতকে খণ্ডন করেন। তাঁর মতে, “আলোর কণিকা” দিয়ে আলো তৈরি। তদবধি যত পরীক্ষানিরীক্ষা হয়েছিল, তারা মতামতকে সমর্থনও করতো।
এরপর ধরাধামে এলেন থমাস ইয়ং (Thomas Young), যিনি দেখালেন, যে আলোর বেশ কিছু আচরণের ব্যাখ্যা ‘কণা-তত্ত্ব’ করতে পারে না, বরং আলোকে তরঙ্গ হিসেবে ভাবলে তাদের ব্যখ্যা করা যায়। যদিও এরপর নিউটনের ‘কণা-তত্ত্ব’ বিশেষ আমল পেলো না, কিন্তু অন্য সমস্যা দেখা দিল। কোনো তরঙ্গ, যেমন—শব্দতরঙ্গ বা জলের ঢেউ—বইতে একটি মাধ্যম দরকার হয়। সূর্য থেকে আলো মহাশূন্যের মধ্য দিয়ে তাহলে কী করে আমাদের কাছে এসে পৌঁছয়? বিজ্ঞানীরা ধরেই নিলেন, সহজতম উত্তরটিই তাহলে সত্য—অকামের ক্ষুর মনে করো—একটি সর্বব্যাপী, সর্বভেদী, আলোক-পরিবাহী মাধ্যম আমাদের চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে, যার নাম তাঁরা দিলেন ইথার (Luminiferous Aether: লুমিনিফেরাস মানে ‘আলোক-বাহী’; রসায়নের ইথারের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই)। এরপর মঞ্চে নামলেন ম্যাক্সওয়েল (James Clerk Maxwell); দেখালেন, তড়িতাধান এবং চুম্বক গতিশীল হলে একরকম তরঙ্গ—নাম তাদের তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ—তৈরি হয়। এই ধরনের তরঙ্গের বেগ পরীক্ষাগারেই মাপা যায়। দেখা গেল, তাদের গতিবেগ আলোর গতিবেগের সমান! ম্যাক্সওয়েলের ধারণা হল—আলো নিশ্চয়ই তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ। ঊনবিংশ শতকের একেবারে শেষের দিকে মাইকেলসন ও মোর্লি (Michelson and Morley) তাঁদের বিখ্যাত পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত করলেন, যে ইথার-এর বাস্তবে কোনো অস্তিত্ব নেই। এই পরীক্ষার ফলে, আলোর ‘তরঙ্গ তত্ত্ব’ একটা বড়সড় ধাক্কা খেল, কিন্তু জলদিই এর একটা সমাধানও পাওয়া গেল: আলোকতরঙ্গের সঙ্গে শব্দতরঙ্গের একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য আছে—আলোকতরঙ্গের কম্পন এমনভাবে হয়, যে তার পরিবহনের জন্যে মাধ্যমের প্রয়োজন হয় না—অকামের ক্ষুরের আরেক প্রয়োগ।
এই কারণেই, আলোক-তড়িৎ ক্রিয়া (Photoelectric effect)-র আবিষ্কারের ফলে তরঙ্গ তত্ত্বের সংকট আরো বেশি হয়। কোনো ধাতুর ওপর আলো পড়লে ইলেকট্রন বেরিয়ে আসতে পারে। পরীক্ষা করে পরিষ্কার দেখা গিয়েছিল, যে তরঙ্গ তত্ত্ব এর ব্যাখ্যা করতে পারে না, উলটে, ততদিনে জনপ্রিয়তা হারানো কণা তত্ত্ব পারে। ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন আলোকতড়িৎ ক্রিয়ার যে ব্যখ্যা দিলেন (যার জন্যে তিনি নোবেল প্রাইজও পান), তা নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করলো, যে আলো আসলে অগুণতি শক্তির পুঁটুলির স্রোত (stream of energy packets)। এর পাঁচ বছর আগেই ম্যাক্স প্লাঙ্ক (Max Planck) এমন পুঁটুলির অস্তিত্বের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, তবে হামানদিস্তায় শেষ ঘা-টা আলোক-তড়িৎ ক্রিয়াই দেয়। এই পুঁটুলিগুলিকে এখন আমরা ফোটন (photon) বলে ডাকি।
আলোর আসল চরিত্র কী দাঁড়ালো তবে? ইয়ং-এর পরীক্ষা এবং ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্ব – দুই-ই যেমন অকাট্য, আলোক-তড়িৎ ক্রিয়াও তেমনই অখণ্ডনীয়। বর্তমানে আমাদের ধারণা, আলো আসলে তরঙ্গ ও কণা – দুই-ই। যেন এক দু-মুখো দানব—যে পরীক্ষা যখন করা হয়, তখন সে সেই অনুযায়ী কোনো একটা মুখ দেখায়—কিন্তু কখনোই দুই মুখ একসঙ্গে দেখায় না।
No comments
মন খুলে মন্তব্য করুন। আমাদের সময়-সুযোগ মতো মডারেশন হয়, তাই মন্তব্য এই পাতায় ফুটে উঠতে কিছু সময় লাগতে পারে। নইলে নিশ্চিন্ত থাকুন, খুব খারাপ কিছু বা স্প্যাম না করলে, মন্তব্য ঠিক বেরোবে এই পাতায়।